শুচিবায়ু নিরাময়ে হোমিও ঔষধ
শুচিবায়ুকে বলা হয় অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিজ অর্ডার বা OCD। এই রোগ নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে আজকের এই নিবন্ধ। এই রোগের দুটো কম্পোনেন্ট। যেমন: ১) অবসেসন ২) কম্পালসন। অবসেসন: একই চিন্তা, প্রতিচ্ছবি বা আবেগ যা নাকি অযৌক্তিক বা অবাস্তব তা বার বার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মনে আসাকে অবসেসন বলা হয়। রোগী তা মন থেকে তাড়াবার চেষ্টা করেও তাড়াতে পারেন না। সবসময় মনোকষ্টে ভোগেন। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে শুধু অবসেসন থাকে, কিছু রোগীর ক্ষেত্রে শুধু কম্পালশন তবে বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে অবসেসন এবং কম্পালশন দুটোই দেখা যায়। কম্পালশন: অযৌক্তিক অপ্রয়োজনীয় কাজ বার বার বাধ্যতামূলকভাবে করতে থাকাকে কম্পালশন বলা হয়। এই কাজটা না করলে রোগীর মনে দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, অস্থিরতা, রাগ, বিরক্তির উদ্রেক হয়-করলে সাময়িক স্বস্তি হয়, পরক্ষণেই আবার চিন্তা ফিরে এসে দুশ্চিন্তা বাড়লে আবার একই কাজ করতে হয়। অবসেসন বিভিন্ন রকমের হয়। যেমন- ১. ফিয়ার অফডার্ট অ্যান্ড কন্টামিনেশন: সবসময় মনে হয় কোনো নোংরা লেগে গেছে বা যাচ্ছে হাত-পা বা শরীরে। তাই সবসময় পরিচ্ছন্ন থাকা- ছোঁয়াছুঁয়ি এড়িয়ে চলা, বাড়ি থেকে বেরোতে না চাওয়া, সবসময় হাত গুটিয়ে বসে থাকা, বিছানা থেকে না নামা ইত্যাদি আচরণ দেখা যায়। কোনো কোনো রোগী কথা বলতে চান না, পাছে মুখ খুললে মুখে নোংরা ঢুকে যায়, জিভ বের করে কথা বলেন না বা খান না-চামচে করে খান নোংরা এড়ানোর জন্য। কেউ কেউ স্নান, খাওয়া ছেড়ে দেন নোংরা এড়াতে। এঁটো বা আমিষের জন্য সর্বদা উদ্বেগে থাকেন কেউ কেউ। থুতু, মলমূত্র আছে বলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রাস্তা দেখে চলা। নিচু জাত বা ভিন্ন ধর্মের লোকের ছোঁয়া লাগার ভয়ে সদা আতংকিত থাকা। ২. অবসেসিভ ফিয়ার অ্যান্ড ফোবিয়া: সবসময় মনে সন্দেহ হয় যে বোধ হয় জলাতংক হয়েছে বা হতে চলেছে। তাই বার বার ডাক্তারের কাছে যাওয়া, রক্ত পরীক্ষা করাতে চাওয়া, প্রতিষেধক নিতে চাওয়া ইত্যাদি। বাড়ি বা রাস্তা ঘাটে কুকুর থাকলে সে বাড়ি বা রাস্তা এড়িয়ে চলে; কুকুর পাশ দিয়ে গেলেও মনে হওয়া যে বোধ হয় কামড়েছে বা চেটে দিয়েছে। সাপের ভয়: সব সময় মনে হয় সাপে বোধ হয় কামড়েছে। ৩. নিড ফর সিমেট্রি: সমস্ত আচরণ বা কাজকে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বা বামে ডানে সমান ভারসাম্য রেখে করার অদম্য ইচ্ছা। যেমন, চলার সময় ডান পা বা বাঁ পা আগে ফেলে চলা; সমস্ত লাইন, পিলার, ল্যাম্পপোস্টের ঠিক সমকোণে পা ফেলা ইত্যাদি। ঠিক এইভাবে না করলে মনে শান্তি আসে না বা মনে হয় ‘না করলে নিকট আত্মীয় বিপদে পড়বে, ঠাকুর অভিশাপ দেবে’-তাই ওই নিয়ম মেনে চলা। ৪. সোমাটিক অবসেশন: মনের মধ্যে বার বার একটি রোগের ভয় আসা-বোধ হয় ব্রেন টিউমার বা থ্রোট ক্যানসার হয়ে গেছে। তাই বার বার নিজেকে পরীক্ষা করে দেখা, বাড়ির লোককে জিজ্ঞেস করা, ডাক্তারের কাছে আসা, ইনভেস্টিগেট করানো ইত্যাদি। কেউ হয়নি বললে সাময়িক শান্তি, আবার দুই মিনিট পরে একই প্রশ্ন-হয়নি তো রোগটা? ৫. অবসেসিভ ডাউট: অমূলক সন্দেহ বার বার মনে আসা যেমন, সুইচ অভ হয়েছে কি না, গ্যাস অভ হয়েছে কি না, দরজায় তালা লাগানো হয়েছে কি না ইত্যাদি। ৬. অবসেসিভ োনেস: সবকিছু অসম্ভব ধীরে করা, কাজ করতে বার বার মনে হওয়া, বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না-তাই ঘুরে করা, কাজ করতে করতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়া, কারণ ছাড়াই ইতস্তত করা, হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদি। ফলে সময়ে কাজ শেষ করতে না পারা। কম্পালশন মূলত দুই রকমের হয়। ১) রিপিটেড বিহেভিয়ার ২) মেন্টাল কম্পালশন। ১. রিপিটেড বিহেভিয়ার ক্লিনিং অ্যান্ড ওয়াশিং: ধোয়াধুয়ি করা। হাত নোংরা হয়ে গিয়েছে। বার বার সাবান দিয়ে ধোয়া। প্রথমে কবজি অবধি ধোয়া, পরে কনুই অবধি, আরও পরে কাঁধ অবধি শেষে পুরো স্নান। স্নান: ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে স্নান, দশ-বিশ বার স্নান করা, বাথরুমে ঢুকলে কল, বালতি, মগ, দেয়াল বার বার ধুয়ে তারপর স্নান করা। পুকুরে গেলে গুণে গুণে ১০ বার বা ১০০ বার ডুব দেয়া, অন্য কেউ ঘাটে এলে বা কারও জলের ছিটে গায়ে লাগলে আবার স্নান করা, ডুব দিতে দিতে গোণায় ভুল হয়ে গেছে ভেবে আবার নতুন করে গুণে গুণে ডুব দেয়া। রিচুয়্যাল: রোগীর ধোয়া বা স্নান করার একটা পূর্ব নির্ধারিত নিয়ম থাকে এবং সব সময় সেটাই অনুসরণ করে। যেমন বাথরুমে ঢুকে মগটা তিন বার ধোয়া, তারপর বালতিটা চার বার, কলটা পাঁচবার, বাঁ দিকের দেয়াল ছয় বার, ডানদিকের দেয়াল সাত বার ধোয়া এই রকমে চলতে থাকে। নিয়মের ভুল হলে আবার গোড়া থেকে পুরো নিয়মটা অনুসরণ করে। চেকিং: বার বার পরীক্ষা করা যেমন, তালা লাগানো হল কি না, সুইচ অভ হল কি না, রাস্তা চলার সময় কারো গায়ে ধাক্কা লেগেছে কি না বা অন্যের গায়ে পা লেগেছে কি না, পায়ে কিছু ফুটেছে কি না, নোংরা পায়ে কেউ ঢুকল কি না ইত্যাদি। অ্যাসিওরেন্স: বার বার অন্যকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হওয়া। যেমন, জামাকাপড় পরেও মনে হল বোধ হয় পরিনি-তাই অন্যকে জিজ্ঞেস করা, ‘জামাকাপড় পরেছি তো? ‘চেন লাগিয়েছি তো? ঠাকুরের গায়ে পা লাগেনি তো? ইত্যদি। রিপিটেড অ্যাকশন: বিছানায় শুতে যাওয়া, আবার নেমে পড়ে আবার ওঠা, আবার নামা; জুতোয় পা গলানো, আবার বের করে নেয়া-আবার গলানো। বার বার একই কাজ এভাবেই করা। অ্যাভয়ডিং: যে সমস্ত জিনিষ শুনলে বা দেখলে অবসেসন বা কম্পালশন বাড়ে সেগুলো এড়িয়ে চলা। যেমন, কুকুর, সাপ, কাঁচি, ছুরি, দড়ি ও নোংরা ইত্যাদি। এজন্য রোগী এসব জিনিস ঘরে রাখতে দেয় না, সোজা রাস্তা ছেড়ে ঘুর পথে চলে, বাড়ির বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এক জায়গায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বা দাঁড়িয়ে থাকে। ২. মেন্টাল কম্পালশন কাউন্টিং: সারাদিন ধরে বার বার ১ থেকে ১০, ১০ থেকে ১০০ বা ১০০ থেকে পিছিয়ে পিছিয়ে ৫০ গুণতে থাকা। রিপিটিং ওয়ার্ড: কোনো একটা শব্দ, যেমন গাছ, কলকাতা, ঢাকা, মাথা-ছাতা ইত্যাদি মাথায় এলে তা রিপিট করতে থাকা। প্রেয়িং: বার বার প্রার্থনা করা। ‘ঈশ্বর আমার প্রণাম নাও; আল্লাহ আমায় মাফ করো; পৃথিবীর ৩৩ কোটি দেবতা আমার প্রণাম নাও’ ইত্যাদি। কখনও বা এক এক করে সব দেবদেবীকে প্রণাম করা-ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন। এই রোগের কারণ: সুনির্দিষ্ট কারণ না পাওয়া গেলেও সম্ভাব্য কারণ হিসেবে যে সমস্ত তথ্য ভাবা হচ্ছে তা হল-জন্মের সময় ব্রেনে আঘাত, হেড ইনজুরি, এনকেফেলাইটিস এবং মৃগী রোগীদের ওসিডি বেশি হয়। অনেক সময় বংশগত কারণও থাকে। সাইকোডায়নামিক থিওরি অনুযায়ী অবচেতন মনে উদ্বেগ কমানোর জন্য কতগুলো প্রক্রিয়ার সাহায্য নেয় যাদের বলা হয় ডিফেন্স মেকানিজম। নিউরোটিক ও সাইকোটিক রোগের লক্ষণ হিসেবে এই ডিফেন্স মেকানিজম প্রকাশ পায়। ৃউঊ রোগীর ক্ষেত্রে কিছু ডিফেন্স মেকানিজম কাজ করে। হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান: বিজ্ঞানী চিকিৎসক হানেমান মানুষের মনস্তত্বের উপর জোর দিয়েছেন বেশি কারণ মন খারাপ হলেই শরীরে প্রভাব পড়ে বেশি। মনস্তত্ত্বকে বাদ দিয়ে হোমিওপ্যাথিতে মানসিক রোগীকে সর্বাঙ্গীন সুস্থ করে তোলা কঠিন। শুচিবাই নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিতে বিশেষ ফলদায়ক চিকিৎসা আছে যা অন্য প্যাথিতে নেই। লক্ষণ সাদৃশ্যে যে সব ঔষধ বেশি ব্যবহৃত হয় তা নিচে দেয়া হল। যথা: ১) একোনাইট ২) আর্সেনিক ৩) এন্টিম ক্রুড ৪) অরামমেট ৫) ক্যামোমিলা ৬) চায়না ৭) ইগ্নেসিয়া ৮) এগনাস ক্যাস্টস ৯) ল্যাকোসিস ১০) এসিড ফস ১১) সোরিনাম ১২) পালসেটিলা ১৩) সিপিয়া ১৪) নাক্সভম ১৫) সালফার ১৬) থুজা ১৭) মেডোরিনাম ১৮) মার্কসল ১৯) স্ট্রামোনিয়াম ২০) ক্যালকেরিয়া উল্লেখযোগ্য। তারপরেও চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থেকে ঔষধ সেবন করা উচিত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন