মিসক্যারেজ বা অকাল গর্ভপাত কী?

প্রকৃতির নিয়ম যেমন শীতকালে গাছের পাতা ঝরে পরে। তেমনি মেয়েদের শরীরে পরম যতনে লালিত মুকুলও ঝরে যায়। যাকে বলে গর্ভপাত, মিসক্যারেজ অথবা প্রেগন্যান্সি নষ্ট হয়ে যায়।  তবে বেশির ভাগ (৯৫%) গর্ভপাতই সাধারণত হয়ে যায় ৮ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে। তাই স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা ১২ সপ্তাহ অবধি সময়টিকে খুব সাবধানে থাকতে বলেন। বাকি ৫% গর্ভপাত হয় ১২ থেকে ২০ সপ্তাহের মধ্যে।

মিসক্যারেজ কীভাবে হয়?
প্রেগন্যান্সির প্রথম ভাগে যোনিদ্বার দিয়ে হতে পারে রক্তপাত, প্রথমে অল্প ও পরে বেশি। প্রেগন্যান্সির ফার্স্ট ট্রাইমেস্টারে (প্রথম ১২ সপ্তাহে) এটা কিন্তু খুব চিন্তার বিষয়। এর সঙ্গে থাকতে পারে তলপেটে একটা খিঁচ ধরা ব্যথা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গর্ভপাতটা হয়ে যায় এভাবেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার কোনও রক্তপাত বা ব্যথা ছাড়াই হতে পারে গর্ভপাত। এক্ষেত্রে গর্ভস্থ ভ্রূণের বৃদ্ধি থেমে গিয়ে তার মৃত্যু হয় গর্ভেই। একেই বলে নিঃশব্দ গর্ভপাত বা মিসড মিসক্যারেজ। এক্ষেত্রে গর্ভস্থ ভ্রূণের হার্ট বিট পাওয়া যায় না আল্ট্রাসোনোগ্রাফির মাধ্যমে।

গর্ভপাতের কারণ?
৫০% ক্ষেত্রে গর্ভপাতের কারণ অজানাই থেকে যায়। এখানে গর্ভপাতের সম্ভাব্য কিছু কারণ চিহ্নিত করা হল।
১) গর্ভস্থ ভ্রূণের যদি কোনও জন্মগত ত্রুটি থাকে তাহলে সেই ভ্রূণকে প্রকৃতি কোনওভাবেই ভূমিষ্ঠ হতে দেয় না। কারণ সেই ভ্রূণ ভূমিষ্ঠ হলেও তা অস্বাভাবিক হওয়ার তুমুল সম্ভাবনা থেকে যায়।
২) গর্ভাবস্থায় ওভারি ঠিকমতো কর্পাস ল্যুটিয়াম তৈরি না করলে প্রোজেস্টেরন হরমোনের অভাবে মিসক্যারেজ হতে পারে।
৩) এছাড়াও রুবেলা, টক্সোপ্লাসমোসিস, সাইটোমেগালো ভাইরাস বা লিস্টোরিয়ার মতো সংক্রমণের কারণেও কিন্তু বিক্ষিপ্তভাবে গর্ভহানি হয়।
৪) কারও কারও ক্ষেত্রে মা ও শিশুর মধ্যে রক্ত চলাচলে সমস্যা তৈরি করে ছোট ছোট ব্লাড ক্লট।
৫) নারীর জরায়ুতে যদি কোনও গঠনগত ত্রুটি থাকে তবে ১২ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যায় গর্ভপাত। অনেক সময় জরায়ুতে সেপ্টাম বা পর্দার মতো থাকে যার ফলে হতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত। জরায়ুতে বড় মাপের ফাইব্রয়েড থাকলে তা গর্ভস্থ ভ্রূণকে বাড়তে দেয় না। এছাড়াও কিছু কিছু মহিলার জরায়ু মুখ আলগা থাকে। যাকে বলে সার্ভাইকাল ইনকম্পিটেন্স যার ফলে জরায়ু বর্ধিত ভ্রূণের চাপ রাখতে না পেরে তাকে বার করে দেয়।
৬) মিসক্যারেজের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা, খুব হাই ব্লাড প্রেশার এমনকী এসএলই বা অ্যান্টিফসফোলিপিড অ্যান্টিবডি সিনড্রোম-এর মতো কোলাজেন ভাস্কুলার ডিজিজকেও চিহ্নিত করা হয়েছে।
৭) গর্ভাবস্থায় ধূমপান (স্বামীর দৌলতে প্যাসিভ স্মোকিং), ড্রাগসের নেশা, অতিরিক্ত মদ্যপান, শরীরে প্রচণ্ড আঘাত বা আই ইউ সি ডি’র ব্যবহার সত্ত্বেও অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ হলে মিসক্যারেজের ঝুঁকি বাড়ে।
  ৮) গর্ভপাতের হার আপনার ধারনার চেয়েও বেশীঃ
সাধারনত আমরা মনে করি, গর্ভপাত একটি দূর্ঘটনা এবং তা খুব কমক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। কিন্তু আপনি কি জানেন প্রায় ১৫% গর্ভধারণই শেষ পর্যন্ত রূপ নেই গর্ভপাতে। এবং যদি প্রাথমিক প্রেগন্যান্সি টেস্টের আগের সময় থেকে ধরা হয়, তবে এই হার প্রায় ৩০%।
৯) গর্ভধারণের শুরুর দিকেই গর্ভপাত ঘটার সম্ভাবনা বেশীঃ
সাধারনত ডাক্তাররা হবু বাবা মা কে বলে থাকেন যাতে ২০ সপ্তাহের আগে প্রেগন্যান্সির খবর সবাইকে না বলা হয়, এমনকি গ্রামেও এটি সাংস্কৃতিক ভাবেই প্রচলিত। কারণ, সাধারনত গর্ভধারণের ১২ সপ্তাহের মধ্যেই গর্ভপাত হবার আশংকা বেশী থাকে। এর পরবর্তীতে রিস্ক কমে আসে।
১০)  গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে আপনার অজান্তেইঃ
গর্ভধারনের প্রথম ১০ দিনের মাথায়ই আপনার অজান্তেই মিসক্যারেজ হয়ে যেতে পারে। রক্তপাত এর একটা খুব সাধারণ লক্ষণ। নারীরা একে পিরিয়ড ভেবে ভুল করতেই পারেন। কিন্তু যদি কখনো অতিরিক্ত রক্তপাত হয়, তবে ঝুঁকি না নিয়ে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। গর্ভপাত না ঠেকাতে পারলেও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা ও সংক্রমণ এড়াতে পারবেন।
১১)  গর্ভপাতে মায়ের কোন দোষ নেইঃ
অকাল গর্ভপাত ঘটে মূলত ভ্রুণের অস্বাভাবিকতার কারণে, এটা আগে থেকে নির্ণয় করা কঠিন আর এতে মায়ের কোন দোষ নেই।
১২)  বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেশীঃ
বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে মিসক্যারেজের ঝুঁকি বেশি। কেননা ডিম্বানুর বয়েসের কারণে জিনগত অস্বাভাবিকতার হার বেড়ে যায়।
১৩)  যৌনতার সাথে সম্পর্ক নেইঃ
আপনার যৌন জীবন, ব্যায়াম বা নিয়মিত হালকা কাজের সাথে অকাল গর্ভপাতের তেমন কোন সম্পর্কে নেই। তবে একটু সাবধান থাকা ভালো। কারণ, গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসে আনপ্রোটেকডেট সেক্স করলে গর্ভপাতের হার বাড়ে।
১৪) গর্ভপাত একাধিকবার হতে পারেঃ
গর্ভপাত একবার হলে আবারো হতে পারে।তাই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
১৫) ফার্টিলিটির চিকিৎসা গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারেঃ
সন্তান ধারনের জন্যে বেশি বয়েসে ফার্টিলিটির চিকিৎসা ও ঔষধ সেবনের কারনেও গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
১৬) ধূমপান, প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষঃ
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপানের কারনেও হতে পারে গর্ভপাত। তাই নিজে ধূমপান তো করবেনই না এবং কোন ধূমপায়ীর আশেপাশে থাকা থেকে বিরত থাকুন।
১৭) অতিরিক্ত ওজনের কারণে হতে পারে গর্ভপাতঃ
অতিরিক্ত ওজনের কারণে নানা স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি হতে পারে গর্ভপাতও! যেমন ডায়াবেটিস, যা অতিরিক্ত ওজনের কারনেই হয়ে থাকে। এটি গর্ভপাতের একটি অন্যতম প্রধান কারণ।

গর্ভপাত নির্ণয়?
প্রেগন্যান্সির ফার্স্ট ট্রাইমেস্টার থেকে যদি রক্তপাত শুরু হয় এবং সঙ্গে থাকে তলপেটে ব্যথা। তাহলে মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও ৮ সপ্তাহ অবধি অপেক্ষা করা সত্ত্বেও যদি গর্ভস্থ ভ্রূণের হার্ট বিট না আসে তাহলেও তার মানে এটি গর্ভপাত। তবে গর্ভপাত নিজে নিজে হোক বা তা অপারেশনের মাধ্যমে করা হোক দুইয়েই আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করে দেখে নেওয়া দরকার জরায়ু সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার হয়েছে কিনা।

গর্ভপাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা?
সাধারণত একবার বা দু’বার গর্ভপাত হলে আমরা বিশেষ কোনও টেস্ট করতে হয় না। তবে মিসক্যারেজ যদি তিনবার বা তার বেশিবার হয় তবে তা সত্যি চিন্তার বিষয়। এই সমস্যাকে আমরা বলি রেকারেন্ট মিসক্যারেজ। মূলত ছয় ধরনের কারণ এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ করা হয়।

জেনেটিক পরীক্ষা করা হয় পিতা ও মাতার যাতে বোঝা যায় তাঁদের মধ্যে কোনও ক্রোমজোমাল ত্রুটি আছে কিনা। গর্ভাবস্থায় আল্ট্রাসোনোগ্রাফির মাধ্যমে বোঝা যায় সার্ভাইকাল ইনকম্পিটেন্স বা জরায়ু মুখের দুর্বলতা। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, এস আই এস অথবা এইচ এস জি পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায় জরায়ুর মধ্যে কোনও ফাইব্রয়েড আছে কি না। তবে এটি নির্ধারণ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে হিস্টেরোস্কোপি নামক পরীক্ষা যাতে জরায়ুর মধ্যে একটি ক্যামেরা প্রবেশ করিয়ে দেখে নেওয়া যায় সত্যি জরায়ুতে কোনও মাংসপিন্ড আছে কিনা। হিস্টেরোস্কোপি পরীক্ষার মাধ্যমে এছাড়াও জানা জরায়ুতে কোনও পর্দা বা সেপ্টাম আছে কিনা। অ্যান্টি কার্ডিওলিপিন অ্যান্টিবডি এবং লুপাস অ্যান্টি কোয়াগুলেন্ট নামক ছোট রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় মা ও শিশুর মধ্যে রক্ত চলাচলে ব্লাড ক্লট কোনও বাধা সৃষ্টি করছে কি না। এছাড়াও অ্যান্টি থ্রম্বিন ‘থ্রি’, প্রোটিন সি এবং প্রোটিন ‘এস’ ডেফিসিয়েন্সির কারণেও ব্লাড ক্লটিং হতে পারে তাই এই রক্ত পরীক্ষাগুলিও করে নেওয়া দরকার। হরমোনাল সমস্যাগুলি চিহ্নিত করা কিন্তু মিসক্যারেজের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তাই ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, প্রোল্যাক্টিন বিভিন্ন হরমোনগুলি সঠিক মাত্রায় শরীরে আছে কি না তা দেখে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। ইউ এস জি-তে যদি পলিসিস্টিক ওভারি ধরা পরে তাহলে কিন্তু মিসক্যারেজের সম্ভাবনা বাড়ায়। যদিও কারণটা এখনও অজানা। অনেক সময় ল্যুটিনাইজিং হরমোন বেশি মাত্রায় থাকলে তা গর্ভপাতের কারণ ঘটায়। রুবেলা, টক্সোপ্লাসমোসিস, সাইটোমেগালোভাইরাস, লিস্টোরিয়া এবং ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজিনোসিস গর্ভপাত ঘটাচ্ছে কি না তা দেখে নেওয়া অবশ্যই দরকার। তবে এ সমস্ত পরীক্ষা করার পরেও আমরা ৫০% ক্ষেত্রে মিসক্যারেজের কারণ সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারি না

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পেয়ারা উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ

জরায়ু ক্যান্সার কী, এর কারন,লক্ষন ও প্রতিকার কী ? ডাঃ এম এইচ মোহন