কানের সমস্যা ও প্রতিকার


কানের সমস্যা বহু ধরনের হতে পারে। এই যেমন টনসিল বা সাইনাসের সমস্যার কারণে কারো কারো কানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। কানের ভেতর হওয়া প্রদাহের কারণেও কখনো কখনো শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পায় বা লোপ পায়। আবার অনেকক্ষণ উচ্চগ্রামের আওয়াজ শোনাও কানের জন্য ভীষণ বিপদ ডেকে আনতে পারে কিংবা বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও শ্রবণক্ষমতা চিরতরে বা কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যেতে পারে। কানে কী ধরনের সমস্যা হয় সে সম্পর্কে জানতে কানের গঠন সম্পর্কে কিছুটা জানা দরকার।

কানের গঠন
কান তিনটি অংশে বিভক্ত। বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ ও অন্তঃকর্ণ। বহিঃকর্ণের অংশগুলো হলো পিনা, বহিঃঅডিটরি মিটাস, টিমপেনিক পর্দা। মধ্যকর্ণের উল্লেখযোগ্য অংশগুলোর মধ্যে রয়েছে_ইউস্টেশিয়ান নালি, কর্ণাস্থি ও ছিদ্রপথ। প্রতিটি অন্তঃকর্ণের আবার দুটি অংশ থাকে। একটি হলো ইউট্রিকুলাস, আরেকটির নাম স্যাকুলাস। কানের প্রতিটি অংশের কাজ একেবারে নির্দিষ্ট। এই যেমন অর্গান অব কর্টি শব্দগ্রাহক যন্ত্ররূপে কাজ করে। কানের তিনটি ছোট হাড় ম্যালিয়াস, ইনকাস ও স্টেপিস শব্দ তরঙ্গ বহিঃকর্ণ থেকে অন্তঃকর্ণে পাঠায়।

শ্রবণ-প্রক্রিয়া
শব্দ তরঙ্গ পিনায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বহিঃঅডিটরি মিটাসে প্রবেশ করে টিমপেনিক পর্দাকে আঘাত করলে সেটা কেঁপে ওঠে। কাঁপনে মধ্যকর্ণে অবস্থিত ম্যালিয়াস, ইনকাস ও স্টেপিস অস্থি তিনটি এমনভাবে আন্দোলিত হয়, ফলে প্রথমে ফেনেস্ট্রা ওভালিসের পর্দা ও পরে অন্তঃকর্ণের ককলিয়ার পেরিলিম্ফে কাঁপন সৃষ্টি হয়। পেরিলিম্ফে কাঁপন হলে ককলিয়ার অর্গান অব কর্টির সংবেদী রোম কোষগুলো উদ্দীপ্ত হয়ে স্নায়ু আবেগের সৃষ্টি করে। এ আবেগ অডিটরি স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের শ্রবণকেন্দ্রে বাহিত হলে মানুষ শুনতে পায়। দেহের ভারসাম্য রক্ষা করাও কানের অন্যতম একটি কাজ।

বহিঃকর্ণের প্রদাহ
কানের অন্যতম সাধারণ সমস্যা হলো বহিঃকর্ণে প্রদাহের সৃষ্টি হওয়া। যেকোনো বয়সেই এ সমস্যার উদ্ভব হতে পারে; তবে বাচ্চাদের এ সমস্যা বেশি হয়। মূলত কানে ময়লা জমে যাওয়া এবং সেটা নিয়মিত পরিষ্কার না করা হলে বহিঃকর্ণে প্রদাহ দেখা দেয়। কানের খৈল বা ওয়াক্সের সঙ্গে ধুলাবালি জমেও প্রদাহের সৃষ্টি হতে পারে। ময়লা পরিষ্কার করার জন্য অনেকেই কটনবাড ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু কটনবাডে লেগে থাকা ময়লা কানে প্রবেশ করেও কানে ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। এ জন্য কটনবাডের পরিবর্তে অলিভ অয়েল ব্যবহার করে খৈল নরম করে নেওয়াই শ্রেয়। এতে কানের ক্ষতি হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।

মধ্যকর্ণের সমস্যা
১. কান পচা রোগ
বিভিন্ন কারণে কান পচা রোগ দেখা দিতে পারে। দুই ধরনের কান পচা রোগ আছে। একটি তুলনামূলক কম বিপজ্জনক, আরেকটি বেশি বিপজ্জনক। বেশি বিপজ্জনক কান পাকা রোগ দীর্ঘমেয়াদে আরো বড় সমস্যা করে এবং এ থেকে কখনো কখনো মৃত্যু ঘটাও অস্বাভাবিক নয়। পানি বা অন্য কিছুর কারণে কানের পর্দা ছিদ্র হয়ে গেলে কান পচা রোগ দেখা দেয়। এ ছাড়া আমাদের কানের ভেতরে অবস্থিত ছোট ছোট হাড় আছে। সেগুলো ক্ষয় হয়ে গেলেও এ সমস্যা হতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় মধ্যকর্ণে কলেস্টিটোমার উপস্থিতির কারণে। এটি এক ধরনের ক্ষতিকর অবাঞ্ছিত পাতলা আবরণ, যা মধ্যকর্ণে সৃষ্টি হয় এবং বাড়তে বাড়তে একসময় মস্তিষ্ক পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে এবং পরবর্তী সময়ে রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ঠিক সময়ে অপারেশনের মাধ্যমে শ্রবণশক্তি ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এ ছাড়া কম বিপজ্জনক কান পচা রোগ (কলেস্টিটোমার উপস্থিতি ব্যতীত) বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওষুধের মাধ্যমে নিরাময় করা সম্ভব। বাংলাদেশে সব ধরণের কান পচা রোগের চিকিৎসা করা হয়; দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। এ কারণে কানে কম শুনতে পেলে বা কান দিয়ে দুর্গন্ধ বের হলে সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত, কোনোভাবেই বিলম্ব করা ঠিক নয়।

২. ওটোস্ক্লেরেসিস
ওটোস্ক্লেরেসিস সমস্যাটা কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে কানের অভ্যন্তরে যে ছোট ছোট হাড় আছে, সেগুলোর জয়েন্ট শক্ত হয়ে যায়, নড়তে পারে না। ফলে শব্দ আর অন্তঃকর্ণ পর্যন্ত যেতে পারে না, তাই শুনতে সমস্যা হয়।

অন্তঃকর্ণের সমস্যা
শ্রবণশক্তি হ্রাস ও লোপ পাওয়া
কানের অভ্যন্তরে হিয়ারিং সেল নষ্ট হয়ে গেলে শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটি বার্ধক্যজনিত কারণে হয়। কানে সঠিকভাবে শুনতে পাচ্ছেন কি না তা বোঝার জন্য নিজে নিজেই কয়েকটি পরীক্ষা করতে পারেন। এই যেমন সবার সঙ্গে টিভিতে কোনো অনুষ্ঠান দেখতে বসে বারবার টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিতে বলছেন কি না কিংবা মিটিংয়ে একটু পেছনে বসে বক্তার আওয়াজ আপনার কানে ঠিকমতো এসে পেঁৗছাচ্ছে কি না ইত্যাদি। এভাবে নিজেই কানের অবস্থা সম্পর্কে সজাগ থাকতে পারবেন। সমস্যা শুরু হবার আগেই বুঝতে পারবেন।
শ্রবণশক্তি হ্রাস পেলে তা পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের হিয়ারিং অ্যাইড (শ্রবণসহায়ক যন্ত্র) সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

শব্দদূষণের কারণে শ্রবণবৈকল্য
আমাদের কান একটি নির্দিষ্ট মাত্রার ওপরের শব্দের প্রতি সংবেদনশীল। শব্দের মাত্রা গ্রহণের জন্য ককলিয়ার স্ক্যালা মিডিয়ায় বিশেষ স্থান রয়েছে। স্থানগুলো হচ্ছে উচ্চমাত্রা গ্রহণের জন্য ফেনেস্ট্রা রোটান্ডা-সংলগ্ন অংশ, মধ্যমমাত্রা গ্রহণের জন্য মাঝামাঝি অংশ এবং নিম্নমাত্রা গ্রহণের জন্য শীর্ষের কাছাকাছি অংশ।
আমাদের কানের শ্রাব্যতার একটি মাত্রা আছে। অর্থাৎ কেউ যদি ক্রমাগত এ মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রায় শব্দ শুনতে থাকে তাহলে একপর্যায়ে আংশিক; পরবর্তীতে স্থায়ীভাবে কানের শ্রবণশক্তি লোপ পেতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে কান ঝালাপালা করে দেওয়া ভুভুজেলার কথা মনে আছে? ভুভুজেলা থেকে নিঃসৃত শব্দের মাত্রা প্রায় ১২৯ ডেসিবেল পর্যন্ত হতে পারে বলে বিশ্বকাপের সময় ভুভুজেলা নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে আসছিল বিভিন্ন সংগঠন।
ঢাকা শহরে শব্দদূষণের মাত্রা ভয়াবহ। নির্মাণাধীন ভবন, যানবাহনের আওয়াজ, উচ্চমাত্রায় দোকানে বা মার্কেটে গান বাজানো, সভা-সমিতিতে মাইকের আওয়াজ ইত্যাদি কারণেই উচ্চমাত্রার শব্দ প্রতিনিয়ত নিঃসৃত হচ্ছে। তবে শব্দদূষণের কারণে শ্রবণ সমস্যায় বেশি ভোগেন রাস্তায় অবস্থান করা ট্রাফিক পুলিশ, দোকানদার প্রভৃতি পেশার লোক। ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা শিশুসহ বয়স্ক মানুষও শব্দদূষণের শিকার হন নিমর্মভাবে। অথচ শব্দদূষণ প্রতিরোধ করা খুব কঠিন কাজ নয়। এ জন্য নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি আশপাশের মানুষকেও সচেতন করে তোলা প্রয়োজন।
অন্য যেকোনো ইন্দ্রিয়ের মতোই কানের যত্নে আমাদের সবারই অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত; নতুবা এক মুহূর্তের অসাবধানতার কারণে বরণ করে নিতে হতে পারে শব্দহীন এক পৃথিবীকে।

শিশুদের কানের যত্নে করণীয়
আপনার বাচ্চা ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছে? তার কানে কোনো সমস্যা আছে কিা? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য শিশুদের নিয়মিত কান পরীক্ষা করা উচিত। প্রায়ই দেখা যায়, কানের সমস্যার কারণে শিশুরা শ্রেণীকক্ষে ঠিকমতো শিক্ষকের কথা শুনতে পায় না এবং এর প্রভাব পরে পরীক্ষার ফলাফলে।
এ ছাড়া যেসব মা বাচ্চাদের বুকের দুধ খাওয়ান এবং কর্মজীবী যেসব মা বোতলে ভরে বাচ্চাদের দুধ পান করান তাঁদের দুধ খাওয়ানোর সময় অবশ্যই অতিরিক্ত কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। লক্ষ রাখতে হবে, দুধ খাওয়ানোর সময় বাচ্চার মাথা যেন একদম শোয়া অবস্থায় না থাকে; অর্থাৎ বুক ও পিঠের তুলনায় মাথা সব সময় যেন কিছুটা উঁচুতে থাকে_এটা নিশ্চিত করতে হবে।
এ ছাড়া বাচ্চাদের ঠাণ্ডা লাগা বা হাঁচি, কাশি একটুও অবহেলা করা উচিত নয়। কারণ নাক দিয়ে অনবরত পড়া পানির কারণে কানের ইউস্টেশিয়ান নালি ছিঁড়ে যেতে পারে। আবার কখনো কখনো টনসিলের ব্যথার কারণেও বাচ্চাদের কানে ব্যথা হতে পারে। এ জন্য দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

যখন ডাক্তার দেখাতে হবে
কান ব্যথা করছে, কাজ করার আগ্রহ পাচ্ছেন না বা ঈষৎ জ্বর অনুভূত হলে;
কান দিয়ে পুঁজ বা রক্ত পড়লে;
কান ভার ভার লাগলে;
কানে ব্যথা হওয়ার আগে মাথা কিংবা ঘাড়ে ব্যথা পেয়েছেন এমন ইতিহাস থাকলে;
কানে কম শুনতে পেলে এবং ধীরে ধীরে পরিস্থিতির অবনতি হলে;
কানে বাইরে থেকে কোনো কিছু প্রবেশ করেছে বলে সন্দেহ হলে।

কানের যত্নে যা করতে পারেন
কানে পানি ঢুকে যায় অনেক সময়ই। অসাবধানতার কারণে ছোটদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা আরো বেশি করে ঘটে। তবে পানি ঢুকে যদি কানের পর্দা পর্যন্ত না পেঁৗছায় তাহলে এটি খুব বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে না। তবে সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। নতুবা কানে পানি জমে পর্দা ফেটে যেতে পারে। কানে পানি ঢোকা রোধে প্রয়োজনে ইয়ার প্লাগ ব্যবহার করতে পারেন। সেটা সম্ভব না হলে অলিভ ও শর্ষের তেলে তুলা ভিজিয়ে চিপে নিয়ে সেই তুলা কানে দিতে পারেন।

ইয়ার ওয়াক্স বা কানের খৈল সরানোর জন্য অনেকেই কটনবাড কিংবা হাতের কাছে পাওয়া অন্যান্য ধারালো কিছু (সুই জাতীয়) ব্যবহার করেন, যা আদতে ঠিক নয়। কানের ময়লা নরম করার জন্য অলিভ অয়েল ব্যবহার করুন।
চুলে খুশকি থাকলে সেটা দূর করার চেষ্টা করুন। কারণ খুশকি কানের মধ্যে প্রবেশ করেও প্রদাহ বা ইনফেকশনের সৃষ্টি করতে পারে।
কানের সুস্থতার জন্য পুষ্টিকর খাবারও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময়ই পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে কানের সঠিক বৃদ্ধি হয় না। সুতরাং এ ব্যাপারে, বিশেষ করে বাচ্চাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।

সব সময় কোলাহলপূর্ণ জায়গায় বসবাস কানের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের কান একটি নির্দিষ্ট মাত্রার শব্দের ওপর অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। তাই যদি আপনার কাজের জায়গায় এমন হয় যে সেখানে সব সময় ভারী মেশিনপত্রের আওয়াজ শুনতে হয়, তাহলে প্রতিরোধব্যবস্থা হিসেবে কানে তুলা ব্যবহার করতে পারেন।
হেডফোন বা ইয়ার ফোনে উঁচু আওয়াজে বেশিক্ষণ গান শোনাও কানের জন্য ক্ষতিকর। এগুলো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।
কনসার্ট বা যেকোনো অনুষ্ঠানে উচ্চগ্রামের শব্দ বেশিক্ষণ শুনলে সেটা কানের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। তাই উচ্চশব্দ থেকে দূরে থাকুন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পেয়ারা উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ

মিসক্যারেজ বা অকাল গর্ভপাত কী?

জরায়ু ক্যান্সার কী, এর কারন,লক্ষন ও প্রতিকার কী ? ডাঃ এম এইচ মোহন