করলার পুষ্টিগুন ও উপকারিতা

করলা পরিচিত এর তিক্ততার জন্য। তাই ইংরেজিতে একে Bitter gourd, Bitter melon অথবা Bitter squash নামে ডাকা হয়। করলা সাধারণত হাল্কা অথবা গাঢ় সবুজ বর্ণের হয়। দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকার কিছু অঞ্চল এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলে উন্নতমানের করলা পাওয়া যায়।

Advertisement
তিক্ত স্বাদযুক্ত করলা বিভিন্ন অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও উপকারী ভিটামিনসমৃদ্ধ। প্রতি ১০০ গ্রাম করলায় বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ-
কার্বোহাইড্রেট : ৩.৭০ গ্রাম, প্রোটিন : ১ গ্রাম, ফ্যাট : ০.১৭ গ্রাম, খাদ্য আঁশ : ২.৮০ গ্রাম, নায়াসিন : ০.৪০০ মিলিগ্রাম, প্যান্টোথেনিক এসিড : ০.২১২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন এ : ৪৭১ আই ইউ, ভিটামিন সি : ৮৪ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ; ৫ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম : ২৯৬ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম : ১৯ মিলিগ্রাম, কপার : ০.০৩৪ মিলিগ্রাম, আয়রন : ০.৪৩ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম : ১৭ মিলিগ্রাম, ম্যাঙ্গানিজ : ০.০৮৯ মিলিগ্রাম, জিংক : ০.৮০ মিলিগ্রাম।
১০০ গ্রাম করলা থেকে মাত্র ১৭ ক্যালরি পাওয়া যায় এবং এতে পানির পরিমাণ ৮০-৮৫%। এই উভয় কারণেই করলা আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে বিশেষভাবে সাহায্য করে। করলায় বিদ্যমান অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট আমাদের দেহ থেকে অপ্রয়োজনীয় পদার্থ নিষ্কাশনে সাহায্য করে, যা আমাদের পরিপাক ও বিপাককে সহজ করে। ফলে আমাদের ওজন দ্রুত হ্রাস পায়।

করলার ভিটামিন সি আমাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে ও যে কোনো ইনফেক্শন থেকে রক্ষা দেয়। যে কোনো ইনফেক্শন থেকে রক্ষা পেতে প্রতিদিন করলা পাতা বা করলাকে পানিতে ফুটিয়ে সেই পানি খেলে উপকার পাওয়া যায়।
প্রাচীন ভারতীয় ও চৈনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে করলা একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই শাস্ত্রে প্রাচীনকাল থেকে টাইপ-২ ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে করলার ব্যবহার লক্ষণীয়। রক্তে অপর্যাপ্ত ইনসুলিন নিঃসরিত হলে অথবা ইনসুলিনের কাজ কোনো কারণে বাধাপ্রাপ্ত হলে আমাদের কোষে চিনির শোষণে ব্যাঘাত ঘটে ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস দেখা দেয়। করলার বিশেষ তিনটি উপাদান, যথা- charantin, vicine, polypeptide-p রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই তিনটি উপাদান এককভাবে বা একত্রে রক্তে চিনির মাত্রা হ্রাস করে। এ ছাড়া করলার lectin নামক বিশেষ উপাদান আমাদের প্রান্তীয় কলার ওপর কাজ করে আমাদের ক্ষুধাকে প্রশমিত করে ঠিক যেভাবে ইনসুলিন আমাদের মস্তিষ্কে কাজ করে।

বার্ধক্য, ক্যানসার ও অন্যান্য আরো অনেক রোগের মূল কারণ হলো আমাদের দেহের মুক্ত মৌলসমূহ। করলার ভিটামিন এ, ভিটামিন সি ও ফ্ল্যাভোনয়েড্স এসব মুক্ত মৌলের বিরুদ্ধে কাজ করে।
করলার আঁশ খাদ্যের পরিপাককে সহজ করে। তাই কোষ্ঠকাঠিন্যে এটি উপকারী।
করলা আমাদের ধমনিগাত্রে যে খারাপ কোলেস্টেরল জমাট বাঁধে, তার পরিমাণ হ্রাস করে ও হৃদযন্ত্রের সুস্থতা রক্ষা করে।

শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত যে কোনো সমস্যা, যেমন- অ্যাজমা, ঠান্ডাজনিত কাশি ইত্যাদি থেকে দ্রুত আরোগ্য পেতে করলার রসের জুড়ি নেই। দুই আউন্স করলার রসের সঙ্গে এক কাপ মধুমিশ্রিত পানি যোগ করে নিয়মিত পান করলে অ্যাজমা, ব্রন্কাইটিস ও ফ্যারিনজাইটিস থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

লিভার রক্ষায়
১ সপ্তাহজুড়ে প্রতিদিন ১ গ্লাস করলার রস পান করলে লিভারের যে কোনো সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়।
করলার রস লিভার পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে। এই রস বিষাক্ত রক্তকে পরিষ্কার করে, রক্তের চলাচলকে সহজ করে ও গেঁটে বাতের ব্যথা উপশম করে।

শক্তি বৃদ্ধিতে
করলার বিশেষ উপাদানসমূহ রক্তকে দূষিত উপাদানমুক্ত রাখে। দুই আউন্স করলার রসের সঙ্গে লেবুর রস মিশ্রিত করে খালি পেটে প্রতিদিন গ্রহণ করা হলে চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে রক্তের জ্বালাপোড়া রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। নিয়মিত করলার রস পানে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়।

চোখের স্বাস্থ্যে
করলায় উচ্চমাত্রার বেটা-ক্যারোটিন থাকায় আমাদের চোখের যে কোনো সমস্যা সমাধানে ও চোখের দৃষ্টি উন্নত করতে করলার জুড়ি নেই।

ত্বকের যত্নে
নিয়মিত করলার রস গ্রহণে সোরায়াসিস ও ত্বকের অন্যান্য ফাংগাল ইনফেকশন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আমাদের ত্বকের সৌন্দর্য্যবর্ধন ও রক্ষা অনেকাংশে নির্ভর করে করলা গ্রহণের মাত্রার ওপর।

চুলের সৌন্দর্যে
ত্বক ও স্বাস্থ্যের সুস্থতা রক্ষা করা ছাড়াও চুলের সৌন্দর্য রক্ষায় করলার বিশেষ ভূমিকা আছে। করলার অন্তর্নিহিত গুণ চুলের যে কোনো সমস্যার সমাধানে সক্ষম।
চুলের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা বজায় রাখতে এক কাপ করলার রসের সঙ্গে দই মিশিয়ে চুলে লাগানোর কিছু সময় পর ধুয়ে নিলে চুল চকচকে হয়।
চুলের ডগা ফেটে যাওয়া একটি সাধারণ সমস্যা। এ থেকে মুক্তি পেতে সপ্তাহে দুদিন ফেটে যাওয়া চুলের ডগায় কাঁচা করলার রসের প্রলেপ দিলে সুফল পাওয়া যায়।
করলা প্রাকৃতিক উপায়ে চুল পড়া বন্ধ করে। এক চিমটি চিনির সঙ্গে করলার রস মিশ্রিত করে চুলে প্রলেপ দেওয়া হলে চুল পড়ার হার হ্রাস পায়।
প্রতি ১০ দিনে একদিন পাকা চুলে করলার রস ব্যবহার করলে চুলের অকালপক্বতা ধীরে ধীরে কমে আসে।
চুলের অতিরিক্ত তৈলাক্ততা দূর করতে করলার রস ও এপেল সিডার ভিনেগারের মিশ্রণ ব্যবহার করা যায়।

সাধারণ ব্যাধিতে
এ ছাড়া কিছু কিছু রোগের ঘরোয়া চিকিৎসায় করলার জুড়ি নেই। যেমন- জ্বর, কাশি, ঋতুস্রাবের ব্যথা, পোড়া ও অন্যান্য ক্ষত। আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে ম্যালেরিয়া ও ভাইরাসজনিত রোগ, যেমন- হাম, বসন্ত প্রতিরোধে ও চিকিৎসায় করলা ব্যবহৃত হয়।

স্তন ক্যানসার রোধে
সাম্প্রতিক গবেষণার ফল থেকে জানা যায় যে, ব্রেস্ট ক্যানসারের জন্য দায়ী কোষসমূহকে ধ্বংস করতে ও তাদের বৃদ্ধিকে প্রতিহত করতে করলা বিশেষভাবে উপকারী।

সতর্কতা
তবে এত উপকারিতা থাকার পরও দিনে দুটির বেশি করলা গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। করলায় কিছু এলকালয়েড উপাদানের উপস্থিতির কারণে কারো কারো এর প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখা দেয়।

করলা থেকে সৃষ্ট বিষাক্ততার লক্ষণগুলো হলো অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ, মুখের লালচে ভাব, দৃষ্টির স্বল্পতা, পেট ব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য, বমি হওয়া, ডায়রিয়া, পেশির দুর্বলতা ইত্যাদি। করলাকে ১০ মিনিট লবণ পানিতে ভিজিয়ে রাখলে বা ফুটিয়ে নিলে এর তিক্ততা ও বিষাক্ততা বহুলাংশে হ্রাস পায়।

বাতরক্ত :- এ ক্ষেত্রে চার চা-চামচ করলা বা উচ্ছে পাতার রস একটু গরম করে সেই সাথে এক-দেড় চা চামচ বিশুদ্ধ গাওয়া ঘি মিশিয়ে ভাতের সাথে খেতে হয়।
পিত্ত শ্লেষ্মাজনিত রোগ :- অনেক সময় ম্যালেরিয়া জ্বরেও পিত্ত শ্লেষ্মার বিকার হয়। এর প্রধান উপসর্গ হলো, শরীর কামড়ানি, পিপাসা ও বমি; এ ক্ষেত্রে উচ্ছে বা করলার পাতার রস এক চা চামচ একটু গরম করে অথবা গরম পানির সাথে মিশিয়ে সারা দিনে ২-৩ বার করে খেলে জ্বরের উপসর্গগুলো চলে যাবে ও জ্বরের প্রকোপও কমে যাবে।
গুঁড়ো কৃমি এ ক্ষেত্রে উচ্ছে বা করলার পাতার রস বয়স্ক হলে ১-২ চা চামচ এবং শিশু হলে আধা চা চামচ সকালে ও বিকেলে অল্প পানি মিশিয়ে খেতে হয়।

প্লীহা রোগের উপক্রম হওয়া :- এ রোগের লক্ষণ হলো বিকেলে চোখ-মুখ জ্বালা করা, নাক-মুখ দিয়ে গরম নিঃশ্বাস-বের হওয়া, মুখে স্বাদ না থাকা। নোনা স্বাদ ও ভাজাপোড়া জিনিসে রুচি বেশি এ ক্ষেত্রে বুঝতে হবে, রক্তবহ স্রোত দূষিত হচ্ছে এবং এর আধার প্লীহা বিকারগ্রস্থ হচ্ছে। এ সময় করলা বা উচ্ছে পাতার রস দুই চা চামচ একটু গরম করে সিকি কাপ পানিতে মিশিয়ে দিনে দু-তিন বার খেতে হয়। এভাবে পাঁচ-ছয় দিন খেলে অসুবিধাগুলো আস্তে আস্তে চলে যাবে।

বাত :- পিত্ত শ্লেষ্মাজনিত এ বাত রোগের লক্ষণ হলো অমাবস্যা, পূর্ণিমা এবং একাদশী এলে হাত-পা-কোমর, সারা শরীরে ব্যথা যন্ত্রণা হয়; ব্যথা নিবারক বড়ি খেয়ে চলাফেরা করতে হয়; শীতকাল এলে কথাই নেই, তবে গরম বেশি পড়লে ব্যথা-বেদনা ও যন্ত্রণা একটু কম হয়। এ ক্ষেত্রে করলা বা উচ্ছে পাতার রস ৩ চা চামচ গরম করে অল্প পানিতে মিশিয়ে দিনে ২ বার করে খেলে এ অসুবিধা চলে যায়।

অরুচি রোগ :- বৈদিক শাস্ত্র মতে, পিত্ত শ্লেষ্মার বিকার না হলে অরুচি রোগ হয় না। এ ক্ষেত্রে এক চা চামচ করে ফলের রস সকাল ও বিকেলে খেলে দোষটা চলে যায়।
রক্তপিত্ত :- যাদের কোনো জ্বালা-যন্ত্রণা ছাড়াই পায়খানার সাথে টাটকা রক্ত পড়ে, অথচ অর্শ্বরোগ নেই এ ক্ষেত্রে রক্ত পিত্ত যে আছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এতে করলা বা উচ্ছের ফুল ৮-১০টা নিয়ে দিনে ৩ বার খেতে হয়। পুরাতন বৈদ্যরা ফুলের রস আধা চা চামচ করে খাবার বিধান দিতেন।

অগ্নিমান্দ্য :- বীজ বাদ দিয়ে পুরো শাঁসের রস ছেঁকে একটু গরম করে প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে খেলে অগ্নিমান্দ্য রোগ সেরে যায়।

এলার্জি :- এ ক্ষেত্রে ফলের রস ২ চা চামচ করে দিনে ২ বেলা খেতে হয়।
দুষ্ট ক্ষত :- যে ঘায়ে রস গড়ায় কিছুতেই শুকাতে চায় না এতে গাছ পুরোটা শুকিয়ে গুঁড়ো করে ঘায়ের ওপর ছিটিয়ে দিলে এবং গাছ সিদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে থাকলে কয়েক দিনেই তা শুকিয়ে যাবে।

আধকপালে মাথাব্যথা :- পাতার রস রগড়ে নিয়ে একটু ন্যাকড়ায় পুরে যে দিকে যন্ত্রণা হচ্ছে সে নাকে রসটা ফোঁটায় ফেলে টানলে কয়েক মিনিটেই ব্যথা সেরে যায়।
ভিটামিনের অভাব :- পাকা করলা বা উচ্ছের বীজ শুকিয়ে রেখে প্রতিদিন প্রায় ১ চা চামচ (৩/৪ গ্রাম) মাখনের মতো বেটে তাতে ৭/৮ চা চামচ পানি মিশিয়ে চা ছাঁকনিতে ছেঁকে সে পানি প্রতিদিন একবার করে খেতে হয়। তাতে এ অভাব পূরণ হবে। এটি পুরনো কালের ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স।

শিশুদের বমি :- তিনটি করলা বিচি ও তিনটি গোলমরিচের গুঁড়ো সামান্য পানি মিশিয়ে খেলে শিশুর বমি বন্ধ হয়।

মূত্রকৃচ্ছ্রতা (প্রস্রাব বন্ধ
হওয়া) :- ১০ চা চামচ করলা পাতার রস একটু হিংসহ খেলে এ রোগ সারে।

অর্শ্ব :- করলার পাতা বা ফলের রস এক চা চামচ অল্প চিনিসহ খেলে অর্শ্ব ও তা থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হয়।

চর্মরোগ :- করলা পাতার রস মালিশ করলে চর্মরোগ সারে। তা ছাড়া এ রস শুকনো ত্বকের জন্য উপকারি। শিকড় পিষে চুলকানি ও ফুসকুঁড়িতে লাগলে তা সারে।
আগুনে পোড়া :- পোড়া ঘায়ে করলা পাতার রস লাগালে তা সারে।
রক্তদুষ্টি :- করলার রস খেলে রক্তের দূষিত বর্জ্য বের হয়ে যায়।

ডাঃ এম এইচ মোহন
বি.বি.এস(এন.ইউ)
ডি.এইচ.এম.এস(ঢাকা)
এক্সপার্ট ইন হারবাল মেডিসিন
দূরারোগ্য জটিল রোগের চিকিৎসক।
মোবাইলঃ 01720382646

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পেয়ারা উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ

মিসক্যারেজ বা অকাল গর্ভপাত কী?

জরায়ু ক্যান্সার কী, এর কারন,লক্ষন ও প্রতিকার কী ? ডাঃ এম এইচ মোহন